Sunday 16 July 2017

"গল্প হলেও সত্যি"

চিঠির আজ বড় খুশির দিন।
 ঘন ঘন ইনজেকশন্,ডঃ পরেল এর থমথমে মেজাজ কিংবা কি যেন নাম ওই ফাজিল ডঃটার সব কিছুকে মেসির ড্রিব-লিং এর মত কাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে-ও আজ মা।
 এখন আর কোনো যন্ত্রণাই বেদনাদায়ক নয়- শরীরের ওপর অযাচিত অথচ প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচির দাপাদাপিকে বেমালুম বলে বোধ হচ্ছে।শরীরের সমস্ত ব্যথাগুলো যেন দলবেঁধে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে যে যার খোলসে।খুব সহজ,স্বাভাবিকভাবে সহযোগী নার্স যখন তুলতুলে ছোট্ট মাথাটাকে আলতো হাতে ওর কাছে এনে জিজ্ঞেস করে 'বলোতো কি হয়েছে তোমার?!'-সেই থেকেই ভালোলাগার রঙিন পাখনাগুলো ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াতে শুরু করে চিঠির বুক জুড়ে।যদি দুহাতে ওই ছোট্ট শরীরটাকে বেশ কিছুক্ষণ ছুঁতে পারতো পরম আদরে,তবে বেশ হতো।
কেমন যেন হালকা বোধ হচ্ছে চিঠির শরীর জুড়ে।বমি পাচ্ছে,পেট দুমড়ে মুচরে বারবার উঠে পড়তে চাইছে শরীরটা।হঠাৎই অস্পষ্ট আবছা খারাপলাগাগুলো কুন্ডলি পাকিয়ে গলার কাছে এসে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।গোটা শরীরটা ঝিম ধরে আসছে যেন।বেড এর দুপাশে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখা হাতদুটো খুলে ফেলতে ভীষণ ইচ্ছে করে চিঠির।ওষুধ ইনজেকশন্ এর গন্ধে গোটা ঘরটাকে আন্দামানের কালকুঠরির মতো মনে হচ্ছে ওর।
তড়িঘড়ি ব্যাস্ততায় ইনজেকশন্ পুশ,সদ্য প্রাণের কান্না ছাপিয়ে কয়েক টুকরো কথা ওর কানে ভেসে আসে-'আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে???? আপনি ঠিক আছেন তো!'
একগুচ্ছ সুখ,ভয়,আশঙ্কা সবমিলিয়ে অনুভূতির এমন ককটেল মিশ্রণ এর আগে কখনো হয়নি ওর।ঝাপসা হয়ে আসা চোখটাকে টেনে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে,জীবনের সবটুকু যেন একদলা ভাতের মতো আটকে রয়েছে গলায়, সামান্য কিছু আঘাত পেলেই বেরিয়ে আসার উপক্রম।না---এমন তো হবার কথা ছিলনা ওর।হিসাবটা এভাবে যে বেহিসাবি হয়ে যেতে পারে,তা স্বপ্নেও ভাবেনি।এখনো অনেক হিসাব বাকি আছে।এভাবে ফাঁকি দিতে পারেনা জীবন।
হিংসার এই পাতালপুরীতে ভালোবাসার পিঠ ঠেকে গিয়েছিল যখন দেওয়ালে,তখন কোন সুদূর মায়াজগতের এক প্রগাঢ় বন্ধন জড়িয়ে ধরেছিল ভালোবাসাকে,ভালোলাগাকে।নিঃ‌শ্বাস নিতে শিখিয়েছিল আবার করে।শরীরের মধ্যে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা অঙ্কুর লড়ার সাহস জুগিয়েছিল।হয়তো সমাজের আর এক প্রতিযোগী হিসাবেই।
তুলনা, প্রতিযোগিতা,এগিয়ে যাওয়ার দৌড় এসব চায়নি চিঠি ও তার ভালোবাসা।তবুও বারবার মুখোমুখি হতে হয়েছে এসবের।
থামেনি কেউই বা বলা যায় থামতে দেয় ও নি কেউ।বুঝতে শিখিয়েছে এভাবেই বাঁচতে হয়।ভালোবাসা নয় পঙ্গু হয়ে বাঁচাকেই প্রকৃত বাঁচা বলে,তাতেই সবাই সুখী,সবাই খুশি।
তালে তাল মেলাতে পারেনি ওরা,পিছিয়ে পড়েছে বারবার।ঠাকুরঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘর লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে।তবুও শক্ত করে ধরে রেখেছে দুটো হাত।পরিবার, সমাজের বিষ কখনো আলগা করতে পারেনি তাদের এই বাঁধনকে।
আজ যখন সব না পাওয়ার মাঝে নতুন এক পাওয়া, তখন তাকে কোনোভাবেই হারাতে
দেবেনা চিঠি।চিঠি জানে, দরজার ওপারে সংকীর্ণ করিডোরটায় দাঁড়িয়ে কেউ যখন ভাবছে নতুন অতিথি কেমন দেখতে হবে! কেউ আবার নিজের সত্ত্বার সাথে তার ভিন্নতার তুলনায় মশগুল, তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে কেউ হয়তো ভাবছে-'আমার চিঠি ভালো আছে তো?!'-
চিঠির বড্ড ইচ্ছে করছে ওর হাতটা ছুঁতে-মাথায় বিলি কেটে আগের মতই বলতে-'চিন্তা কোরোনা, আমি ঠিক আছি, ভালো আছি'।
                                                 (ক্রমশঃ)



"গল্প হলেও সত্যি"

(দ্বিতীয়)

জেব্রা ক্রসিং এর সাদা ডোরাগুলো দ্রুত পেরিয়ে স্পর্শ যখন কলেজের সামনের লনটায় এসে পৌঁছলো, তখন কাউন্টারে রেশন দোকানের মতো ভীড়।গোটা পঁচিশেক কালো মাথা কিচির মিচির করছে।ডায়ে-বাঁয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সিনিয়র জুনিয়রদের জটলা।
 আজ পার্ট-টু ফী জমা দেওয়ার শেষ দিন।সুবিধামতো জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতেই-'কি রে এত লেট্ করলি কেন?চাপ খেয়ে গেছিলাম!এদিকে তোর ফোনটাও.........ভুট্টোর কথায় ফুলস্টপ পড়ার আগেই উপরের ঝুল বারান্দা থেকে হিসহিস,ফিসফিস,মুখ চাপা অস্পষ্ট হাসি কানে এলো।
কাউন্টার থেকে কলেজের এই বারান্দাটার অবস্থান কোনাকুনি।অনেকটা জ্যামিতিক নাইন্টি-সিক্সটি আকৃতির মতোই।তাই উপর,নিচে চোখাচুখি কথাকোথি বেশ সহজ।ঘটনার ঘনঘটা অনেকটা ফিল্মি পর্দার মতো।কিন্তু স্পর্শ কোনোদিনই কোনোভাবেই নিজেকে মেলে ধরতে চায়নি,চায়ও না।সে পড়াশুনা কি অন্য কিছু।তেরছাভাবে সামান্য দেখেই চোখ নামিয়ে নেয় ও।হালকা গোলাপি রঙের চুড়িদার কামিজ আর তাকে ঘিরে লাল,হলুদ,বেগুনির মেলা।এই সময়টায় মনে হয় কে যেন মাটি ভর্তি আস্ত একটা ফুলগাছের টব সজোরে ওর বুকের উপর চাপিয়ে দেয়।পা দুটো আড়াল খুঁজতে চায়।মনের ঢাকনাটাকে আঁটোসাঁটো করতে করতে নিজেকে বলে-স্পর্শ,তুমি উড়তে পারবেনা।কেউ যেন রং-পেন্সিল হাতে ছাই রঙের প্যাস্টেল শেড করে দেয় ওর সমস্ত রঙিন খাতা জুড়ে।তেতো হয়ে ওঠে মনটা।কিন্তু ও জানে, ওর মন জানে বেমানান এই বারান্দাটা বড্ড মানানসই।গোটা কলেজের থেকে এটা একদম অন্যরকম।সামান্য ঝুঁকে পড়ার কায়দায় নতজানু হয়ে আছে।
'ধ্যান করছিস নাকি?চলে গেল তো।!!!' আচমকা ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরলো স্পর্শের।
'কেসটা কি বলতো?!ওকে দেখলেই তুই নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত রি-অ্যাক্ট করিস কেন বুঝিনা!!!'- মিরাক্কেল হাসি দিয়ে ভুরু নাচালো ভুট্টো।
কেসটা জন্ডিস না টাইফয়েড তার সমাধান করা স্বয়ং বরাহমিহীরের অসাধ্য।ওকে দেখামাত্রই স্পর্শ নিজের মাঝামাঝি হাইট-এর শরীরটাকে ভিড়ে বেশ যত্ন করে আড়াল করে।ছোটবেলা থেকে নিজেকে আড়াল করতে একেবারে সিদ্ধহস্ত ও।সবার মাঝে থেকেও কিভাবে নিজের মনকে সবকিছু থেকে দূরে রাখা যায় জানে ভালোরকম।ওর মনে কি ঘটছে,কি ঘটতে চলেছে তা ওই জানে।
তাই ভুট্টোর কাছে নিজের কেস ফাইল বন্ধ করে বলে-'আরে তেমন কিছুই নয়,সামলে চলি ভাই।'
ভুট্টো,ভালো নাম সৌহার্দ্য।মাসি,কাকী,নতুন কাকী,পাড়াতুতো দিদি,কমপ্লেক্স দিদি এদের দিকে সৌহার্দ্যের হাত যেভাবে বাড়ায় তাতে আর কিছু না হোক,এ নাম স্বার্থক।
স্পর্শের সাথে ওর মেশামিশি আছে তবে মাখামাখি নেই।মা-র এই কথা কানে বাজে সবসময় "মিশিও তবে মাখামাখি কোরোনা।"ভুট্টো  আর ওর তফাৎ অনেকটা।খাওয়া দাওয়া,ওঠাবসা এমনকি পরিবার জীবনও ভিন্ন।ব্যবসাদার বাবা,মা-র একমাত্র সন্তান ভুট্টো।আগামী ভাবায় না।তাই কেস খাওয়া,কেস খাওয়ানো অনেকটাই সহজ ভুট্টোর কাছে।একই পাড়া, স্কুল,টিউশন,তারপর কলেজ ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব এনেছে।
'চল্ হাঁটা লাগাই,আমার আবার জিমে যেতে হবে।আজ বাইকটা সার্ভিসিংয়ে দিয়েছি।'-কাউন্টারের কাজ মিটিয়ে স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে ভুট্টো ওরাংওটাং-এর মতো পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলো।ইদানিং ভারী ওজোন তুলে তুলে ও বেশ খানিকটা ভারী হয়েছে।পাশে কেউ থাকলে তার ঘাড়ে নিজের ওজনের চল্লিশ-শতাংশ চাপিয়ে দেয়।

পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে শর্মার দোকান ছাড়িয়ে ওরা ফায়ার ব্রিগেডের দিকে হাঁটা লাগালো।এখনো তিনটে বাজেনি।তাই বাস ব্রিগেডের সামনে দিয়েই যাবে।

বাস মানে মিনিবাস।
এই তো সেদিন কলেজে আসার সময় বাসস্ট্যান্ডের হাত চারেক দূর থেকেই স্পর্শ দেখে কেবিনে বসে রবিন পাখির মতো খুব চঞ্চল,অস্থির ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মেয়েটা।সবসময় কি যেন এক অস্থিরতা ওর মধ্যে।মনে হয়,হটাৎ কোনো স্পেসশিপ  ওকে ধরাধামে দিয়ে গেছে।সাধারণের চেয়ে দ্রুততা তাই বেশ বেশি।
বিপদ ঘন্টি বেজে উঠেছিল স্পর্শের মনে।রেলিং দিয়ে ঘেরা গাছগুলো রং হারিয়ে তামাটে হয়ে গেছে।সরকারি,বেসরকারি দুটো গুমটির মাঝামাঝি বসে পাগলি বুড়ি রোজের মত আজও একমাথা ভর্তি সিঁদুর মেখে ফেলে ছড়িয়ে মুড়ি খাচ্ছে।
উপায় নেই।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়িয়েছে।এক পা দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে বাসের উপরে উঠেছিল স্পর্শ।কপালের ঘাম মুছে রুমালটা পকেটে পুরতে যাবে কি-"দ্যাখ,আমি চুল কেটেছি।"
একেবারে সুপার হিরো চরিত্রগুলোর মতো হাওয়ার বেগে এসে বসে অনেকটা কাছে,স্পর্শের গা ঘেঁষে।

আগুনের গোলার মতো মার্চ মাসের কড়কড়ে রোদ গোটা শহরটাকে যেন পাঁপড় ভাজা করে দিচ্ছে।কিন্তু স্পর্শের সমস্ত শরীর জুড়ে দমকা এক ঠান্ডা জলো হাওয়া বয়ে চলেছে।রেলিং-এর ওপারে যেখানে টাক্সিগুলো দাঁড়ায় ,দুটো পায়রা খুব কাছাকাছি।সামনের ধুলো পড়া না জানি কবেকার হোডিং এ চোখ চলে যায় ওর,লেখা-'বসন্ত এসে গেছে'।
                                      .....(ক্রমশ)




"গল্প হলেও সত্যি"

(তৃতীয় অংশ)

"ক্যায়া কার রাহি হো শ্রে, আন্ধেরা হো গ্যায়া বত্তামিজ লারকি,ঘার যাও"!!---গলায় সামান্য তাপ নিয়ে কথা বলতেই, ওদিক থেকে পাল্টা অমান্য কানে এলো -"উফ্, আপভিনা নানী-জি- যা রি ম্যা'য়'। আকেলী থোরি হুঁ, শেরেয়া ভি তো হ্যা'য়'।বেকার মে "---  "হাঁ,হাঁ, ম্যা'য়' তো বেকার মেই বাক বাক করতি হুঁ, ক্যা কারু?! জিন্দিগী নিকাল গ্যায়া কাম কারতে কারতে,মানতা কৌন হ্যায়।সুনতা কৌন হ্যায় ?!"---
সাঁঝবাতিটা জ্বালাতে জ্বালাতে মেজাজটা যেন আরো তেতো হয়ে গেল নানী-জির।
নানী-জি--
হিসাবমত দুই মেয়ের ঘর মিলিয়ে তিন পোতি আর এক পোতার নানী তিনি।তবে হিসাবের বাইরে লিখিত,অলিখিত আরো বেশ কিছু পোতা-পোতি আছে।টেনে টুনে লিস্টি প্রায় শতাধিক।নানী-জি ভালো নাম চন্দ্রকলা কুকরেত্তি।জীবনকাল ষাট পেরিয়েছে বছর ছয়েক হলো।ছিপছিপে গরন, তামাটে মুখাবয়ব কিংবা কড়া পড়া বলিষ্ঠ হাতের তালু দেখলে সহজেই আন্দাজ  করা যায় সময়ের বহু টাইফুন বয়ে গেছে জীবনের উপর দিয়ে।তবুও অফুরন্ত আদর, ভালোবাসা আর চন্দ্রকলা দেবীর বুক ভরা সহানুভূতিতে অক্সিজেন পায় অনেকে।শস্য-শ্যামলা ভারতের মতো এনার মন বড়ই উর্বর।তাতেই ফলে উঠেছে দামি অথচ নামহীন বহু সম্পর্ক।আর তিনিও যত্ন করে সেই সমস্ত চারায় জল দেন নিয়মিত।
ঠাকুরঘরের কৃষ্ণ-রাধার মতো শাশুড়ি জমানার গাই-গরু লতা,তার মেয়ে সোমি থেকে কর্কশ দাঁড়-কাকটাও পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে।বিধাতা যেন একগামলা হোয়াইট-ওয়াশ ঢেলে দিয়েছে মন জুড়ে।যাকে কোনোদিন কোনোভাবেই আবছা করা যাবে না।তবুও মাঝে মাঝে হটাৎ করে উড়ে আসা ধূসর যেন বুক জুড়ে ঘোরাফেরা করে।আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে সাদা-কালোর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া সেই দাম্পত্যকে।নুয়ে আসে মেরুদন্ড-"শুন রাহে হো আপ্! কৈ ভি মেরি কাদার নেহি কারতা, ইতনি সি থি সাব, আজ সাব লায়েক বান গায়ে।কৈ ভি নেহী"---গলা ধরে আসে অভিমানের মিছিলে।
আসলে অভিমান নয়।এটাকে বলে মান।
মানটা ছোট থেকেই বড় বেশি তাঁর।ঈশ্বর যেন ভালোবাসা,সহানুভূতি,মান এসবের পারদ একটু বেশি মাত্রায় দিয়েছেন চন্দ্রকলা দেবীকে।কখনো গুমোট,কখনো  বৃষ্টি,কখনো আবার জ্বালা ধরা তাপ প্রকৃতির খামখেয়ালির মতো বয়ে গেছে তাঁর জীবনের নানা খাতে।তবুও থেমে থাকেনি লড়াই।পিছিয়ে যায়নি পা।
আজ যখন নতুন প্রজন্মের স্বাধীন,স্বেচ্ছা মেঘকে উড়ে বেড়াতে দেখেন,তখন মনে পড়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই দিনগুলো।সাধ হয় টাইম মেশিনে পুরোনো অতীতকে ফিরিয়ে এনে মেলে ধরতে নতুনের সামনে।
সামশেরগঞ্জ কি তেরা-গাঁও সমাজের পর্দা বার বারই আড়াল করেছে তাঁর শিক্ষাকে।চলার পথে বাধা দিয়েছে তাঁর রুচিকে।শ্বশুর ঘরের নোটিশ জারি ছিল- কোনোভাবেই ঘরের বৌমার মুখ যেন বাইরের পুরুষ দেখতে না পায়।চার দেওয়ালে থাকবে শুধু দরজা,থাকবেনা কোনো জানলা।সমাজ যেন উজাড় করে সব কুসংস্কার ঢেলে দিয়েছে এই আঙিনায়।তবুও শক্ত চোয়ালে বারবার প্রতিহত করেছেন এলোমেলো দমকাকে।ঘিরে আসা কাঁটার মোকাবিলা করেছেন,পাহাড়ের মতই।

পাহাড়,
কোনোটা শেওলা-ধরা রং,কোনোটা আবার গুঁড়ি রঙ্গা বাদামি,আবার কোনোটা পুরোপুরি সব কিছু মিলেমিশে ক্যানভাসের পাতায় তুলি ডোবানো হরেক রঙের জলের মতো দেখতে।পাশাপাশি,ঘেঁষাঘেঁষি, মেশামিশি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমস্ত রাজ্য জুড়ে।গোটা উত্তরাখণ্ডের পাহাড় যেন যোজন বিস্তৃত রণ-পা লাগিয়ে পাহারা দিচ্ছে আদি অনন্তকাল ধরে।ঠিক যেমনটি চন্দ্রকলা দেবী  পাহাড়প্রমান ছাতা হয়ে আগলে রেখেছেন তাঁর গাই-গরু, তাঁর বিঘা-তিনেক জমি,তাঁর তুলসীতলা, তাঁর লিখিত অলিখিত সমস্ত ভালোলাগাকে।এ যেন বাতাসেরই গুণ।এই হওয়াতেই হয়তো আছে সেই আদরের গন্ধ।সেই আদর যাকে ছুঁতে,যার ঘ্রাণ নিতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে সকলে।ধুলো,বিষ,কালো এসবকে বস্তাবন্দি করে যেন একফালি সাদা অক্সিজেন শহুরে জীবনের সেলাইন।এত বৈচিত্র্য, এত রঙিন,এত আকাশ যে এখনো বেঁচে আছে তা হয়তো এ মাটির মেয়ে না হলে অজানাই থেকে যেত-চন্দ্রকলা দেবীর।এ মাটি,এ সবুজ যেন তাঁর আত্মা।তাঁর প্রাণ।
ক্রিমরঙা খুব গোছানো একটা একতলা বাড়ি।নিপুণ হাতে কেউ যেন এ বাড়ির কাঠামোকে গুছিয়ে রেখেছে।ছাদের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠে,বাঁ হাতে ছোট্ট একটা চাতাল ঘর।মাথার উপরে গাঢ় নীল।উপর অংশ অনেকটা স্বাধীন।অনেকটা মুক্ত।জায়গাটা বড় প্রিয় তাঁর।এখানেই ক্ষেতে প্রাণ পাওয়া উরাদ্(ডালবিশেষ),পালং,জ-ও(যব)-কে নেড়েচেড়ে বস্তাবন্দি করে কিছুটা কাছে রেখে,বাকিটা সকলকে দুহাত ভরে দেন।ভায়োলিনের মতো একটানা বৃষ্টি,আজকের আলো ফোটা সকালকে অনেকটা স্পষ্ট করেছে।প্রকৃতি নিজের জমে থাকা না বলা টুকরো কথাগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে যেন শান্ত হয়েছে।গাছের পাতায় শেষ রাতের বিন্দু চুয়িংগামের মতো লেগে রয়েছে।এ যেন পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রহ। প্রকৃতি কাউকে পরোয়া করেনা এখানে।ঋতুরা একে অপরের পরিপূরক।রূপ,রস,গন্ধ নিয়ে প্রত্যেকেই 100শতাংশ উজাড় করে দেয়।ফাঁকি দেয়না কেউই।বৃষ্টি দাগে নোনতা ধরা দেওয়ালে কাপড় মেলতে মেলতে চোখ চলে যায় সামনের খাটো,বেঁটে অথচ বেশ পুরুষ্ঠ পাহাড়টার দিকে।ধোঁয়া ওঠা মেঘগুলোকে বুক দিয়ে জড়িয়ে আছে।মা যেমন তার সন্তানকে দুহাতে চেপে লুকিয়ে নেয় তার তাপে ঠিক তেমনই।বেশ লাগে তখন।
আজ চুলে পাক ধরেছে।সবল কোমর কখনো শরীরের ভারে মাথা নোয়ায়।তবু নতুন বই এর মলাটের মতো অদ্ভুত এক নতুনের গন্ধ মিশে আছে এই ছবিতে।বারবার দেখেও যা আবারও নতুন।
নতুন আরো অনেক কিছু। এখান থেকে অশ্বিনীদের আম-বাগান খুব সহজেই চোখে পড়ে।ডাম্প ধরা রাস্তা সোজা চলে গেছে বাগান পেরিয়ে আরো অনেকটা।এদিক ওদিক ছোটখাটো মুদি দোকান পাড়ার অস্তিত্ব জানান দেয়।হটাৎ চোখে পড়ে সেই সংকীর্ণ পথ ধরেই আসছে  এক যুবকের বাইক।কি অসম্ভব দ্রুততা।চড়ে বেড়ানো ষাঁড়-গাইকে পাশ কাটিয়ে  স্তব্ধতার বুক চিড়ে দানবের মতো ছুটে আসছে এদিকে।এর পর নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না তিনি।এতদিনের,এতবছরের স্বচ্ছতাকে চোখের সামনে কেউ যেন চারকোল দিয়ে কালি করে দিলো।ঝিম ধরে আসা হাত দুখানি অসাড় হয়ে যায়।ঝাপসা চোখে দেখলেন- ধুলো উড়িয়ে চলে গেল কোনো এক অশরীরি।আর সেই পথ ধরেই আসছে বোকা,অল্প বদমেজাজি সেই বহুবছর আগের ছোট্ট পাগলি মেয়েটা।তার সেই ছোট্ট 'শ্রে'।
আজ যেন হটাৎ করে বড্ড বড়,বড্ড অচেনা মনে হলো ওকে।
         
                             (ক্রমশ)